ভারত যাকে বন্ধু ভেবেছিল, সে শত্রু হয়ে উঠল? ট্রাম্পের ফিরে আসার পর ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে ফাটল কেন

 



ভারত যাকে বন্ধু ভেবেছিল, সে শত্রু হয়ে উঠল? ট্রাম্পের ফিরে আসার পর ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে ফাটল কেন



নয়াদিল্লি: আমেরিকার প্রভাবশালী রাজনীতিক ও কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, “আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া আরও মারাত্মক।” ভারতের ক্ষেত্রে এই কথা কোভিড-১৯ মহামারীর পরের বিশ্বে সত্যি হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে যখন ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। 



পোখরান: আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা

ইউরেশিয়ান টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকায় রাজনৈতিক বিভেদ বাড়তে শুরু করে। এর ফলে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কেও ওঠানামা দেখা যায়। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভারত নীতি ১৯৯৩-২০১৭ সালের মধ্যে গড়ে ওঠা ঐকমত্য থেকে আলাদা হতে শুরু করে। বিল ক্লিনটনের সময়ে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে শুরু করে। তখন ভারত অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে এগিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে পোখরানে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার পর সম্পর্কে কিছুটা তিক্ততা তৈরি হয় এবং পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।


ভারতকে বিচ্ছিন্ন করার নীতিতে পরিবর্তন

জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে আমেরিকা ভারতকে পারমাণবিক বিষয়ে বিচ্ছিন্ন করার নীতি পুরোপুরি বদলে দেয়। তিনি ভারত-আমেরিকা বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে ভারত পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি (NPT) ও ব্যাপক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তির (CTBT) সদস্য না হয়েও তার বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়।


ওবামার ‘এশিয়া ফোকাস’ নীতিতে সম্পর্কের উন্নতি

রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সময় ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। এর একটি বড় কারণ ছিল ওবামার ‘এশিয়ার দিকে ফোকাস’ নীতি। এই নীতির লক্ষ্য ছিল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে কৌশলগত ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো। এর উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া ও বিশ্বে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষা করা।


২০১৭ সালে সম্পর্কে বড় পরিবর্তন

২০১৭ সালে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের দিক ও নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে। মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সম্পর্কের জায়গায় লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি প্রাধান্য পায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, পারস্পরিক চুক্তি এবং চিনকে ঠেকানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। তবে ট্রাম্প ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (TPP) থেকে সরে আসায় আমেরিকার এশিয়া-প্রশান্ত (পরে ইন্দো-প্যাসিফিক) অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় বাধা পড়ে। তবে এই সময়ে ভারত-আমেরিকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।


বাইডেনের আমলে ভারতের আলাদা পথ

মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের (২০২১-২০২৫) সময়ে ভারত-আমেরিকার কৌশলগত সম্পর্কের পরীক্ষা হয়। বিশেষ করে যখন রাষ্ট্রপতি রাশিয়া ইউক্রেনে তার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে। আমেরিকা রাশিয়াকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে এবং তার ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে অভিযান শুরু করে। কিন্তু ভারত তার ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ নীতির ভিত্তিতে আলাদা পথ বেছে নেয়।


রাশিয়ার নিন্দা করতে ভারতের অনীহা

ভারত আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) চাপের মুখেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি। রাশিয়া ভারতের পুরনো ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু। ভারত জাতিসংঘে রাশিয়ার নিন্দা করা থেকে বিরত থাকে এবং ২০২২ সালের মার্চে আমেরিকার আনা একটি প্রস্তাবে ভোট দেয়নি। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশে পরিণত হয়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারত প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেলেরও বেশি তেল আমদানি করছিল। সস্তা তেল ভারতকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। তখন বিশ্ব জ্বালানি, খাদ্য ও সারের সংকটে জর্জরিত ছিল। ভারতের স্বাধীন জ্বালানি নীতি রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে দেয়।


ট্রাম্পের ফিরে আসায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল

২০২৫ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনা কমলেও সম্পর্কে নতুন ফাটল তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বাণিজ্য। ২০২৫ সালের এপ্রিলে ট্রাম্প একটি জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (IEEPA) ব্যবহার করে সব আমদানির ওপর ১০% এবং ওষুধ, অটো পার্টস ও পোশাকের মতো ভারতীয় রপ্তানির ওপর ২৭% পর্যন্ত ভারী শুল্ক আরোপ করেন। এর ফলে আমেরিকায় যাওয়া ৮৭% ভারতীয় পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে প্রচুর অর্থ সাহায্য

ট্রাম্প অপারেশন সিন্দুরের সময় একতরফাভাবে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তিনি ‘পারমাণবিক বিপর্যয়’ ঠেকানোর কৃতিত্ব নেন, যদিও ভারত আমেরিকার কোনো মধ্যস্থতার কথা অস্বীকার করে। এই সময়ে আমেরিকা ও জি-৭ নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) পাকিস্তানকে গুরুত্বপূর্ণ ঋণ দেয়।