হিমালয়ের কাছাকাছি কিং কোবরার উপস্থিতি: জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন সংকেত
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় গত এক মাসে ১০টি বিষধর সাপ উদ্ধার হয়েছে, যার মধ্যে ৯টি কিং কোবরা এবং ১টি মনোকলড কোবরা। এই সাপগুলো সাধারণত নিম্নভূমির আর্দ্র ও উষ্ণ পরিবেশে বসবাস করে, কিন্তু এবার সেগুলো হিমালয়ের পাদদেশে পাওয়া গেছে, যা বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব হিসেবে দেখছেন।
কিং কোবরা ও মনোকলড কোবরা: কেন এত বিপজ্জনক?
কিং কোবরা (Ophiophagus hannah) পৃথিবীর দীর্ঘতম বিষাক্ত সাপ, যা ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের বিষ অত্যন্ত শক্তিশালী নিউরোটক্সিন ধারণ করে, যা শিকারকে দ্রুত অচল করে দিতে পারে। সাধারণত এরা ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের ঘন জঙ্গলে বাস করে। অন্যদিকে, মনোকলড কোবরা (Naja kaouthia) তার ফণার পিছনে গোলাকার চিহ্নের জন্য চেনা যায় এবং এরা দক্ষিণ এশিয়ার নিম্নাঞ্চলের জলাভূমি ও কৃষিজমিতে বেশি দেখা যায়।
কাঠমান্ডু ও আশেপাশের এলাকায় সাপের উপস্থিতি
স্থানীয় বাসিন্দারা সম্প্রতি ভাঞ্জিয়াং, গুপালেশ্বর, সোখোল ও ফুলচৌকের মতো আবাসিক এলাকায় এই সাপগুলো দেখতে পেয়েছেন। উদ্ধারকারী দলগুলো বাড়ির ভেতর ও আশেপাশ থেকে সাপগুলো ধরে নিরাপদে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, কিছু এলাকায় সাপের বাসা ও ডিমও পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই প্রজাতিগুলো হয়তো স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস শুরু করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব
বিজ্ঞানীরা বলছেন, নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে, যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাপগুলোর জন্য বসবাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করছে। গবেষণা অনুযায়ী, হিমালয় অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রতি বছর ০.০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নিম্নভূমির তুলনায় দ্রুততর। এর ফলে আগে যেসব এলাকা সাপদের জন্য অনুপযুক্ত ছিল, সেগুলো এখন তাদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছে।
অন্য সম্ভাব্য কারণ: মানবসৃষ্ট পরিবহন
কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, নেপালের তরাই অঞ্চল থেকে কাঠ, শস্য বা নির্মাণ সামগ্রীর সঙ্গে অনিচ্ছাকৃতভাবে এই সাপগুলো উচ্চভূমিতে চলে আসতে পারে। উদ্ধারকারী সুবোধ আচার্য বলেন, "মালবাহী গাড়ি বা কৃষিপণ্যের মাধ্যমে সাপগুলো অজান্তেই নতুন এলাকায় পৌঁছে যেতে পারে, যা তাদের বিস্তারে সাহায্য করে।"
নেপালে সাপের কামড়ে মৃত্যু: একটি চলমান সংকট
যদিও উচ্চভূমিতে সাপের উপস্থিতি নতুন ঘটনা, নেপালের দক্ষিণাঞ্চলীয় তরাই এলাকায় সাপের কামড়ে প্রতি বছর হাজারো মানুষ মারা যায়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রায় ২,৭০০ জন সাপের কামড়ে প্রাণ হারান, যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এই সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন শুধু সাপ নয়, বন্যপ্রাণীর পুরো বাস্তুতন্ত্রকে বদলে দিচ্ছে। এই পরিবর্তন মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ, গবেষণা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। নেপাল সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে পরিবেশ ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন শুধু তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের হিসাব নয়—এটি প্রতিটি প্রজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। সময় থাকতে সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট দেখা দিতে পারে।